মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০১১

বেচা বিক্রি...ব্যবসায় বাণিজ্য।

ফুটপাথের এক কোনায় পাশের পাগলটার গা বাঁচিয়ে সাবধানে বসলাম। মোটা এক ধরনের কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা গা থেকে ক্যামন বিটকেলে গন্ধ। আজকাল আর শান্তিতে কোথাও বসার উপায় নাই! পিছনের থামের মত দেখতে বিল্ডিংটার এদিকে বিকালে রাজ্যের মানুষজনের ভিড়, তাই পেছনের বাগানের পাশ দিয়ে যাওয়া ফুটপাথে জিরানোর চেষ্টা করি একটু। দুপুরের খাবারটা এখনো কেমন ভুটভাট করছে পেটের ভেতর। একটু ঝিমিয়ে নিই, একটু পরেইতো আবার হিসাব নিয়ে বসতে হবে!

পিঠের ব্যাগ থেকে আস্তে করে মোটা খাতাটা বের করি। খুব সাবধানে রাখছি আজকাল এই জিনিস, কেউ দেখে ফেললেই সর্বনাশ! এই নিয়ে উনাশিবারের মতো হিসাবটা দেখলাম, কোথাও ভুল ভ্রান্তি থেকে গেলে পরে শোধরানোর উপায় থাকবেনা, বিরাট ঠকা খেয়ে যাব। পায়ের আঙ্গুল গুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম সব হিসাব ঠিক আছে কিনা! বেশ ডুমশো ধরনের, ফোলা ফোলা আঙ্গুল। দেখতে তো ভালোই। দুইটা বুড়ো আঙ্গুলপায়ের আঙ্গুলের কাজ তেমন বেশী না। না থাকলেও মানুষ তেমন চিন্তা করেনা। দামটা আর একটু কমিয়ে ধরবো কিনা বুঝতেছিনা। দুইটা আঙ্গুল মিলিয়ে ১০০০টাকার বেশী হবেনা মনে হয়। বাকি গুলা মিলিয়ে সেট হিসাব করলাম। দুই সেট। নিজের বুদ্ধিতে নিজেই খুশী হলাম। সেট এর আইডিয়াটা এই মাত্র মাথায় আসলো। পুরো পায়ের আঙ্গুলের সেট হিসাব করলে কেমন হয়!

যাক সে পরে দেখা যাবে। হাঁটুর বাটি দুইটা পাইকার বলছে খুব দামি। তাহলে দাম ধরি ৫০হাজার টাকা করে। এইবার মনটা ভালো হয়ে গেলো। দুইটা বাটি ১লাখ। কি করব এতো টাকা দিয়ে? গোড়ালি থেকে উপরের অংশ, বাটি বাদ দিলে তেমন দামি না, আজকাল নাকি ওই জায়গায় স্টিল দিয়ে তৈরি জিনিস ও ফিট হয়ে যায়। কি দুনিয়া পড়ছে, মানুষের আর দাম রইলো না। স্টিল ফিস্টিল দিয়ে মানুষ বানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে রাস্তায়! তলপেটের কাছে এসে মন আবার ফুরফুর করে উঠলো, দুইটা কিডনি। ২৫লাখ করে ৫০লাখ! ওরে! শেরাটনের খানা আমি খামুই! দুই পায়ের ফাকের জিনিসটা কেউ কিনবো কিনা পাইকার বলে নাই। ইচ্ছা করতেছিলো ওর কাছেই বেচি জিনিসটা।

আর দামি জিনিস বলতে নাকি হার্ট! ওইটার নাকি অনেক দাম, পাইকার বেটা কি জানে কি জানি। আমার মনে হয়ে শরীরের ভিতর আরো অনেক যন্ত্রপাতি আছে! এইযে ওইদিন টেম্পুর ধাক্কা খেয়ে যখন রাস্তার পাশে পড়ে গেলাম, চোখ দিয়ে কি পরিমান পানি বের হলো! শরীরের ভেতর কোন পাম্প না থাকলে পানি সাপ্লাই দিলো কে? তারপর ধরেন বাতাস টানলে পরে শরীরে গিয়ে জমা হয়, জিনিসটা শরীরে কোথায় থাকে, ওইটা কি দরকারি কোন যন্ত্র না? তারপর ধরেন এইযে দুপুরে খেলাম, জিনিটা কোথায় গিয়া জমলো, আবার বিকাল হইলেই পেটটা খালি খালি লাগে। তারমানে শরীরে ভিতর আরো ব্যপার স্যাপার আছে। আমি জানিনা, পাইকার বেটা নিশ্চয় জানে।

পাইকার বলছে একটা হার্টের দামই নাকি ৫০লাখ। সব বিক্রি করে দিব একদিন! মাথার চুল বা পায়ের নখ, সবই নাকি দামি! এই সব লাখ লাখ কোটি কোটি টাকার জিনিস পত্র নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে আজ কাল ভয় লাগে। ভাগ্যিস আর কেউ এইসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।

বড় আম্মা

আমরা ডাকতাম বড় আম্মা। আম্মা আব্বা ডাকতেন নানীজীপ্রথম দিকের স্মৃতি যা মনে পড়ে তা হলো সাদা শাড়ি পরা একজন বুড়ো মানুষ। সফেদ চোখ মুখ। বিড়ালের চোখের মতো ঘোলা চোখ। হাতে তসবি। জায়নামাজে বসা। আমার স্বল্প স্মৃতিতে বড় আম্মাকে কখনো জায়নামাজ ছাড়া অন্য কোথাও দেখিনি। তাকালেই মনে একটা শান্তি শান্তি ভাব চলে আসত।

বড় আম্মার ছেলে ছিলেন একজন। আম্মার মামাআম্মা বলতেন মামুজী। চিটাগাংএর মাঝারি মানের ব্যবসায়ী। সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি মারা যাবার পর বড় আম্মা অতি দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে যেতে লাগলেন। সফেদ চামড়া আরো সফেদ হয়ে গেলো। দেখাশোনার জন্য আমার এক মামা চলে আসলেন তাঁর কাছে। মামাকে শেষে বিয়ে করে নানা বাড়িতেই থেকে যেতে হলো নানীজীর সেবা করার জন্য। আমাদের বাড়ী থেকে হেঁটে যেতে সময় লাগতো মিনিট দশেক, তাই আব্বা আম্মার দায়িত্ব ছিলো বড় আম্মার খোঁজ খবর রাখা। আমাদের আকর্ষণ ছিলো অন্য জায়গায়। শুধু মাত্র বড় আম্মাকে দেখতে গেলেই আমরা ছোটরা মগভর্তি লাল চা খেতে পারতাম, কেউ চোখ রাঙ্গাতো না। গরম চায়ের সাথে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়া...আহা!!

আম্মার মামাতো ভাই বোনেরা মায়ের সাথে চট্টগ্রামে স্থায়ী হয়ে গেলেন। বড় আম্মা নিজের মানুষবিহীন হয়ে এক নাতি আর নাত বউকে নিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। বড় আম্মাকে দেখতে যাওয়ার পেছনে আমাদের আরো দুটো কারন ছিলো। প্রথমটা হচ্ছে, ঢোকার মুখে হাতের বাঁ পাশে বহু পুরনো আমলের সোফাসেট। ফোম বিহীন। তার বদলে ছিলো প্লাস্টিকের একধরনের কাভার। বস্লে স্প্রিং এর মতো লাফিয়ে উঠতো। আমাদের অতি অবশ্য কাজের মধ্যে ছিলো বড় আম্মাকে সালাম দিয়ে লাল চার সন্ধান, সেটা হয়ে গেলে সেই সোফায় উঠে লাফালাফি এবং লাফালাফির এক পর্যায়ে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া। বাড়ি ফিরতাম আব্বার কাঁধে করে ঘুমন্ত অবস্থায়। ২য় কারন ছিল বড় আম্মা যে ঘরে থাকতেন সে ঘরের সামনের দিকটায় ছিল বারান্দা। দিনের বেলায় গেলে মূল ঘরের চাল থেকে স্লিপ করে বারান্দার চালে এসে থামার সে এক দূর্দান্ত খেলা আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। ঘরের ভিতরের লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি বা ধমক শুনে সময় নষ্ট করার সময় আমাদের কারোরই ছিলোনা। ফিরতাম হাফপ্যান্টের পিছনে টিনের চালের যাবতিয় ময়লা এবং জং নিয়ে। সেগুলো ধুতে আম্মার বারোটা বেজে যেতো এখন সেটা বুঝতে পারি।

বড় আম্মার পরহেজগারীর গল্প শুনতাম। বড় আব্বা (আম্মার নানা) মারা যাবার পর থেকে তিনি কোন বেগানা পুরুষের সাথে দেখা করেননি। আব্বা ছিলেন উনার ডাক্তার এবং ছেলের মতো। নাত্নির জামাই। সে হিসাবে হয়তো ছাড় ছিলো কিছুটা আব্বার জন্য। রাতদিন ২৪ঘন্টাই ইবাদত নিয়ে থাকতেন। খেতেন খুব সামান্য। বাচ্চা কাচ্চাদের পরম আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। বাপ মার পিটুনি থেকে বাঁচতে চাইলে শুধুমাত্র বড় আম্মার আশপাশে আসলেই মুশকিল আসান। তাঁর বিশ পঁচিশ গজের মধ্যে কোন রকম চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ।আমি কখনই তাঁকে কোথাও যেতে দেখিনি। অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার পর নাতিরা ঢাকা নিতে চাইলেন, চিটাগং নিতে চাইলেন ডাক্তার দেখানোর জন্য, বড় আম্মা নড়েন নি। একবার বড় মামা অনেক কৌশল করে একটা ছবি তুলেছিলেন। বড়ো আম্মা খুব মন খারাপ করেছিলেন। সবাইকে ওয়াদা করতে হয়েছিলো এই ছবি বাইরের কাউকে দেখানো হবেনা। সেই সাদাকালো ছবি বড় ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা হলো, ছবির সামনে ছিলো জানালার পর্দার মতো পর্দা লাগানো। বড় আম্মাকে দেখতে মন চাইলে পর্দা ফাঁক করে দেখে আবার ঠিক করে রাখতে হতো। আব্বা, আম্মা, মামাদের দেখেছি সেই ছবি দেখে চোখের পানি মুছতে।

বড় আম্মা হঠাত করে খুব বেশী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আব্বার ডিউটি বেড়ে গেলো। গভীর রাতে দেখতে যেতে হতো। তারপর একদিন রাতে খবর আসলো বড় আম্মা মারা গেছেন। শোক বোঝার বয়স মনে হয় তখন হয়নি। কান্নাকাটি করেছিলাম কিনা মনে পড়ছেনা। এখন যখন কোন বৃদ্ধাকে সাদা শাড়ি পরে আছেন। বড় আম্মার সফেদ মুখ চোখের সামনে চলে আসে। কিছু মানুষ কিভাবেই না অবুঝ চোখ পেরিয়ে মন মগজের গভীরতায় কোথায় হারিয়ে যান। আবার কোথা থেকে মনের মাঝে হাজির হয়ে যান বুঝতে পারিনা।

বড় আম্মারা এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছেন। আমরা বুঝতেও পারিনা কি হারিয়ে ফেলছি! যখন বুঝতে পারি তখন জবরজং জগত এতো বেশী সত্য হয়ে যায়, বড় আম্মাদের মনে হয় সুদূর প্রবাসের মানুষ, যাদের মনের চোখেই ভালো দেখতে পারা যায়।

বুধবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১১

সংস্কৃতির খানাখাদ্য

অফিস থেকে ফেরার পথে দেখলাম বাসার পাশের খালি জায়গায় ছোট একটা মঞ্চ মত তৈরি করা হয়েছে। পাশে শুটকা কিছু পোলাপানের দল। বুঝলাম, কোন হট্টগোলের আয়োজন করা হয়েছে। কয়দিন পরপরই এদের নানান কায়দা কানুন বের করে আমাদের ঘুমের বারোটা বাজাতে দেখি। শীত শুরুর পরে এদের ব্যাডমিন্টন শুরু। সে খেলা শুরু হয় রাত ৮টার পর, শেষ হয় বারোটা একটার দিকে। চিৎকার চেঁচামেচিতে আমরা যারা নিজের পকেটের পয়সায় চলি তাদের ঘুমের দফারফা, নিশ্চিত এই দামড়া গুলা বেলা ১০টা পর্যন্ত ঘুমায়। আর আমাদের সেই ভোর ছয়টায় উঠে দৌড়াতে হয়। যে বন্ধু আমার সাথে থাকে সোজাসাপ্টা খিস্তি শুরু করে ওই জায়গার মালিকের উদ্দেশ্যে "শ্লার ভাই, জায়গাটা খালি রাখছস কেন? তোর টাকা না থাকলে ডেভেলপারদের দিয়া দে, ডেভেলপাররে দিতে না চাইলে আমাগোরে দে। তাও জায়গাটা খালি রাখিস না"

যা হোক ৩০ডিসেম্বর আবার কিসের অনুষ্ঠান হতে পারে ভাবতে ভাবতে পাশ কাটাচ্ছিলাম জায়গাটা। চোখ পড়লো হলুদ ব্যনারে। "নববর্ষ উপলক্ষে ড্যান্স এর অনুষ্ঠান"। এই রকম আয়োজন আমি আর কখনো দেখিনি কোনদিন। গানের অনুষ্ঠানের কথা শুনেছি, পাড়ার ছেলেরা আয়োজন করে। দুই একজন বড় ভাই থাকেন, হাতের পেশী ফুলিয়ে সেদিন হেঁটে বেড়ান। মুরুব্বিরা মুখ হাঁড়ি করে চায়ের দোকানে বসে থাকেন। কিন্তু ড্যন্সের অনুষ্ঠান কখনো দেখিনি। মনে কৌতুহল জাগ্লো, কারা নাচবে? কিভাবে নাচবে, কোন গানের তালে নাচবে? বাসায় উঠে ফ্রেশ হতে না হতে নিচে শুরু হয়ে গেলো দ্রিম দ্রিম। হাত মুখ মুছতে মুছতে বারান্দা দিয়ে উঁকি দিলামলোকে লোকারণ্য! যেদিকে তাকাই খালি মানুষ আর মানূষ। চশমা চোখে দিয়ে মানুষগুলোকে ভালো মত দেখার চেষ্টা করলাম। দেখে মনে হলো বেশীর ভাগ নিম্নবিত্তের মানুষ। যাক বিনোদনের একটা সোর্স তো বেচারারা পেলো আজকে!

কিছুক্ষন পরে নিচে বিদ্ঘুটে শব্দে বেজে উঠলো অচেনা কোন একটা ইংরেজি গান, কিছুক্ষন কানপেতে শুনে বুঝলাম "কোপা শামসু" টাইপ ইংরেজি কোন গান হবে। S এবং X এই দুটি বর্ণের বহুল ব্যবহারে গানটির অবস্থা জির্নশীর্ণ। কৌতুহল হলো এ গানের সাথে অংগটি নাচছে, সেই হাত আর পা গুলো দেখার। বারান্দায় গিয়ে তাকালাম, গরম বাজনার সাথে কোন মতে তালহীন অবস্থায় নড়ে চড়ে যাচ্ছে এক কিশোর। রঙ্গিন বাতিটাতি জ্বেলে ব্যপারটার মধ্যে একটা মহিমা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে! অনেক কায়দা কানুনের পর বেচারার নাচ শেষ হলো, মানে গান শেষ হয়ে গেলো আরকি!

এইবার একটা কুইজ। "কইঞ্চেন দেহি, এর পর রাইত বারোটা পইযযন্ত ওই ডান্স অনুষ্টানে কি কি নেত্য পরিবেশন করা হইছেলো?" ঠিক ধরেছেন, এর পর বাকি ঘন্টাখানেক সময় বিকট সুরের হিন্দি, আর তার সাথে ততোধিক বিকট নৃত্য। অসম্ভব রিদমিক কিছু গান ছিলো, কিন্তু গান আর নাচের মহিমা যদি এক সুরে বাঁধা না হয় তাহলে দুইজনের সৌন্দর্যই বিনষ্ট হয় পুরোপুরি! আমার লেখার উদ্দেশ্য নাচের কোয়ালিটেটিভ কোন সঙ্গায়ন নয়। যেটা বক্তব্য সেটা হচ্ছে, আমাদের মন মজ্জা আর রক্তের সাথে মিশে যাওয়া অন্য এক সংস্কৃতির ভেতরটাকে দেখার একটু চেষ্টা। হিন্দি ছাড়া আমাদের কোন কিছুই সম্পুর্ণ হয় না এ এক আজব সত্য কথা! বিয়ের অনুষ্ঠান, বর্ষশেষের অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ, বর্ষ শুরুর অনুষ্ঠান!

খান সাহেব অলরেডি আমাদের বিষন্ন হওয়ার কিছু মাল মসলা দিয়ে গেছেন। আমরা আমাদের গাল, পিঠ, হৃদয়, পা... সবকিছু খান সাহেবদের দিয়ে দিয়েছি। অল্পের জন্য একজন হবু বউকেও দিয়ে দিচ্ছিলো! (যেভাবে খান সাব ম ম শব্দ দিয়ে কি সব করলেন, ভয় ই পাচ্ছিলাম!!)। আর ঘরে ঘরে ঘর ঘর কী কাহানী কাভি শাস ভি কাভি...... (বানান ভুল হলে ক্ষমা চাই) তো চলছেই। এইবার দেখলাম ঘরের নিচে, পাড়ায় রাস্তায় হিন্দির সুরে নাচন আর কুর্দন। কিছু হিন্দি গান আমার কাছে অসম্ভব সুন্দর মনে হয়। আমার মোবাইলে এক্টাই হিন্দি গান স্টোর করা আছে তু জানে না......এই অসম্ভব রিদমিক গান্টির বিরুদ্ধে আমি চাইলেও কিছু বলতে পারবোনা। কিন্তু নাচার জন্য মাঝি নাও ছাইড়া দের মতো ভালো গান আছে হিন্দিতে? আমাদের নাচার জন্য?

সংস্কৃতি হৃদয়ে লালন করার জিনিস, পালন করা প্রয়োজন একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। বর্ষশুরুর দিন রমনার বটমূল, ছায়ানটের রবীন্দ্র সঙ্গীত ছাড়া আমাদের সংস্কৃতির মূল সেতু আর কি আছে বলুন? এই ভীড় বাট্টায় যাওয়ার ইচ্ছাটা কেমন জানি মরে গেছে, কিন্তু টিভিতে ছায়ানটের অনুষ্ঠান না দেখলে ১লা বৈশাখের কোন গুরুত্ব কি থাকে? ভয়ে ভয়ে আছি কোন দিন জানি ক্যম্পাসে না জানি ১লা বৈশাখে বেজে উঠে ইশক ইশক...ধুম্মা চালে। স্বপন আর মাহফুজুর রহমান্দের বীজ তো বাংলাদেশেই আছে তাইনা?

শেষের ঘটনা হচ্ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্ধোধনি অনুষ্ঠানে অবদান রাখার জন্য আনা হচ্ছে বচ্চনদের, আসছে নৃত্যশিল্পিরা। সংখ্যাটা নাকি শয়ের কাছাকাছি। জানিনা লিস্টে নিপা, অর্ণব, হাবিব, তপুরা আছেন কিনা। মনে হয় নেই। খান সাহেবের আসার কোটা মনে হয় শেষ, তাই এখন বচ্চন আসবেন। বিশ্ববাসি দেখবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট হচ্ছ্ Indian subcontinent এ। বাংলাদেশকে ভাবতে পারে ভারতের একটি প্রদেশ। আমাদের জ্ঞানি গুনিরা বচ্চনদের পা ধোয়া পানি খেয়ে অমরত্ব লাভ করবেন, মাহফুজুর রহমান সাহেব হয়তো বউকে হিন্দির সাথে মিশিয়ে আরো মহিয়ান করে দেবেন। আর আমরা আমজনতা পাছায় আইক্কাঅলা বাঁশ অনুভব করেও হি হি করে হাসবো, হাততালি দিয়ে হাত ফাটিয়ে ফেল্বো!

ভরসা একটাই টাইগার নামক পুঁচকে ছোঁড়া গুলো ওইদিনই লোটাস কামালদের হতাশ করে দাদাদের হারিয়ে দেবে। সাকিবের চোখের আগুন আর হাতের ঘুর্ণিতে দিশা হারাবে ব্লুজ দের ব্যাট। তামিমের পিটুনিতে ত্রাহি অবস্থা হবে হরভজনদের। আমাদের সংস্কৃতির লোহিতকণিকায় হিন্দি সংস্কৃতির এই রিপ্লেস্মেন্টের চমতকার এক জবাব হবে সেটাই!

বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১০

সাইকেল বাইসাইকেল

একটা সাইকেল আমার শৈশবের অনেক বড় আনন্দের উপাদান হয়ে ছিলো। সাইকেলে চড়তে শেখা, প্রথমে সাইকেল হাতে নিয়ে ছোটা, তারপর বাঁকা হয়ে মাঝখানের ফাঁকা দিয়ে পা ঢুকিয়ে অনেক কসরত করে চালানো কারন সিটে বসে প্যাডালের নাগাল পেতামনা! তারপর এক দিন রডের উপর বসে ব্যথা উপেক্ষা করে তুফান বেগে সাইকেল চালানো। ঝুঁকিপূর্ণ, জান হাতে নিয়ে চালানো যাকে বলে!

তারপর কোন একদিন আবিষ্কার করলাম সাইকেল চালানো আসলে হচ্ছে ব্যালেন্স নিয়ন্ত্রণের ব্যাপার। তারপর সহজ হয়ে গেলো বিষয়টা। কোন আত্মীয়স্বজন বাড়ীতে আসলেই তাদের সাইকেল নিয়ে আমার হাওয়া হয়ে যাওয়া। বেড়াতে আসা আত্মীয়ের হয়তো ফেরার সময় হয়ে যেতো আমার ফেরার নাম নেই। পথে ঘাটে আছাড় খেয়ে পড়া, অন্যদিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে রাস্তা ফেলে ধান ক্ষেতে নেমে যাওয়া, রাস্তায় ছুটে বেড়ানো দুইএক্টা পিচ্চির সাথে সঙ্ঘর্ষ এসব ছিলো নিয়মিত।

আব্বার সাইকেলটা ছিলো এক পরম রহস্যের মতো! জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছিলাম অতি পুরনো সেই দ্বিচক্রযানটা। অনেক রহস্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় রহস্য ছিলো ওই সাইকেল্টার কোন ব্রেক ছিলোনা। স্রেফ উইদাউট এনি ব্রেক-আব্বা সাইকেল্টা চালাতেন। কোন একদিন হয়তো নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, আব্বা টান মেরে খুলে ফেলে দিয়েছেন, আর লাগানোর দরকার বোধ করেন নি। এলাকায় সাইকেল ছিলো হাতে গোনা, তারমধ্যে পরিষ্কার ব্যবধান নিয়ে সেই সাইকেল যত্রতত্র পড়ে থাকতো। সবাই চিনতো কার সাইকেল এটা। এমন ও হতো আব্বা সাইকেল রেখে কোথাও গেছেন ফিরে দেখেন সাইকেল নেই, আব্বা হেঁটে বাড়ী চলে আসতেন, কিছুক্ষন পর কেউ একজন সাইকেল ফেরত দিয়ে যেতো সাথে কাঁচুমাঁচু জবাব একটু দরকার আছিল, বাজারে গেছিলামকেউই কিছু মনে রাখতোনা। বাজার থেকে ফিরে অনেক রাতে আব্বা সাইকেল্টা ঘরের বাইরে রেখে দিতেন নিশ্চিন্তে!

ব্রেকবিহীন সাইকেল চালানো আমাদের কাছে এক বীরোচিত কাজ মনে হলেও আব্বার কাছে ব্যাপার টা ছিলো ডালভাতের মতো। সেই সাইকেল দিয়ে আস্তে সাইকেল চালানো প্রতিযোগীতায় আব্বা জয়ী হতেন! ব্যপারটা কিভাবে সম্ভব ছিলো জানিনা। শুধু দেখতাম আব্বার পুরনো সাইকেল শামুকের গতিতে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে একেবারে থেমে যাচ্ছে, আব্বা শুধু ব্যলেন্স ঠিক করে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যদিকে ব্রেকওয়ালা সাইকেল গুলো যাচ্ছে, চালক ব্রেক চাপছেন আর ধপাস করে পড়ে যাচ্ছেন। আস্তে সাইকেল চালানো প্রতিযোগীতার নিয়ম হচ্ছে কে কতো বেশী সময় নিয়ে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হতে পারেন। মাটিতে পা পড়লেই ডিস্কোয়ালিফাইড।

সেই সাইকেল নিয়ে কতো বার রাস্তা পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকেছি তার কোন সংখ্যা নেই, গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে থেমেছি, রিকশার পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করেছি। সেই সাইকেল নিয়ে একটা দৃশ্য পুরোপুরি মনে আছে এখনো। একদিন বাড়ী ফেরার সময় দেখলাম ব্রেকবিহীন সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে বসে আছে একটি টিয়া পাখিসেই টিয়া পাখি নিয়ে আমাদের সেকি উত্তেজনাময় দিন যাপন! মানুষজন মাঝে মাঝে বলতো ডাক্তার সাব, সাইকেল্টা পাল্টান এইবার

মানুষের কথায় নাকি আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই কিনা আব্বা নতুন একটা সাইকেল কিনে ফেললেন। ফনিক্স। কড়া ব্রেক, কঠিন স্পীড! ব্রেকবিহিন সাইকেল এর ও ক্রেতা খুঁজে পাওয়া গেলো। এক সাইকেল মেকানিক ওই জিনিস কিনে নিলো ২০০টাকায়। তারপর সেই সাইকেলের মাথা, অন্য সাইকেলের চাকা এভাবে জোড়াতালি দিয়ে ছোটদের সাইকেল বানিয়ে মেকানিক ভাড়া দেয়া শুরু করল। আমার দেখা সেটাই ছিলো পৃথিবীর প্রথম ম্যানুফেকচারিং অথবা রিসাইক্লিং প্রসেস!!

নতুন সাইকেল নিয়ে এর পর শুরু হলো টেনশন। তালা ঠিক মতো কাজ করে কিনা, কোথাও গেলে সাবধানে রাখা, ঠিকভাবে তালা মারা। সাইকেলে তেল দেয়া, পরিষ্কার করা আরো কত কি! এর পর আমাকে দাদা সাইকেল কিনে দিলেন ক্লাস সেভেন এ উঠার পর। হিরো সাইকেল। কি গতি! আমি হাওয়ায় উড়ে বেড়ালাম!

ইউনিতে উঠেও সাইকেল কিনেছিলাম। ঢাকার অলিগলি ঘুরেছি। মোটর সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে নারিকেল গাছের অর্ধেক্টা উঠে গিয়েছিলাম বাইকসুদ্ধ। ব্রেকবিহীন সাইকেলের চাইতে বেশী চালিয়েছি ব্রেক সহ সাইকেল। অথচ কি অদ্ভূত, সাইকেলের কথা মনে উঠলেই প্রথমে মনে পড়ে সেই ব্রেকবিহীন , রঙ ওঠা, জরাজীর্ণ দুইচাকার যান টার কথা!

কত দিন গেলো! সেই ব্রেকবিহীন সাইকেল নেই, আব্বা নেই। সাইকেলের সামনে চড়ে কতো সবুজ পার হয়েছি, ডুবে গিয়েছিলাম গভীর নীলে! ধুলো মাখা পথ, দূরদুরান্ত পাড়ি দিয়েছি। সাইকেলের সামনে বসে আব্বার গায়ের গন্ধ পেতাম, ঘামের গন্ধ পেতাম! এটা কি ওটা কি বলে ব্যস্ত করে রাখতাম।

শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় ব্রেক বিহীন সেই দুই চাকার বাহন টা পেলে চলার পথটা হয়তো আরো একটু মসৃন হতো, সাথে সেই চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া গায়ের গন্ধটা!