বুধবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১১

সংস্কৃতির খানাখাদ্য

অফিস থেকে ফেরার পথে দেখলাম বাসার পাশের খালি জায়গায় ছোট একটা মঞ্চ মত তৈরি করা হয়েছে। পাশে শুটকা কিছু পোলাপানের দল। বুঝলাম, কোন হট্টগোলের আয়োজন করা হয়েছে। কয়দিন পরপরই এদের নানান কায়দা কানুন বের করে আমাদের ঘুমের বারোটা বাজাতে দেখি। শীত শুরুর পরে এদের ব্যাডমিন্টন শুরু। সে খেলা শুরু হয় রাত ৮টার পর, শেষ হয় বারোটা একটার দিকে। চিৎকার চেঁচামেচিতে আমরা যারা নিজের পকেটের পয়সায় চলি তাদের ঘুমের দফারফা, নিশ্চিত এই দামড়া গুলা বেলা ১০টা পর্যন্ত ঘুমায়। আর আমাদের সেই ভোর ছয়টায় উঠে দৌড়াতে হয়। যে বন্ধু আমার সাথে থাকে সোজাসাপ্টা খিস্তি শুরু করে ওই জায়গার মালিকের উদ্দেশ্যে "শ্লার ভাই, জায়গাটা খালি রাখছস কেন? তোর টাকা না থাকলে ডেভেলপারদের দিয়া দে, ডেভেলপাররে দিতে না চাইলে আমাগোরে দে। তাও জায়গাটা খালি রাখিস না"

যা হোক ৩০ডিসেম্বর আবার কিসের অনুষ্ঠান হতে পারে ভাবতে ভাবতে পাশ কাটাচ্ছিলাম জায়গাটা। চোখ পড়লো হলুদ ব্যনারে। "নববর্ষ উপলক্ষে ড্যান্স এর অনুষ্ঠান"। এই রকম আয়োজন আমি আর কখনো দেখিনি কোনদিন। গানের অনুষ্ঠানের কথা শুনেছি, পাড়ার ছেলেরা আয়োজন করে। দুই একজন বড় ভাই থাকেন, হাতের পেশী ফুলিয়ে সেদিন হেঁটে বেড়ান। মুরুব্বিরা মুখ হাঁড়ি করে চায়ের দোকানে বসে থাকেন। কিন্তু ড্যন্সের অনুষ্ঠান কখনো দেখিনি। মনে কৌতুহল জাগ্লো, কারা নাচবে? কিভাবে নাচবে, কোন গানের তালে নাচবে? বাসায় উঠে ফ্রেশ হতে না হতে নিচে শুরু হয়ে গেলো দ্রিম দ্রিম। হাত মুখ মুছতে মুছতে বারান্দা দিয়ে উঁকি দিলামলোকে লোকারণ্য! যেদিকে তাকাই খালি মানুষ আর মানূষ। চশমা চোখে দিয়ে মানুষগুলোকে ভালো মত দেখার চেষ্টা করলাম। দেখে মনে হলো বেশীর ভাগ নিম্নবিত্তের মানুষ। যাক বিনোদনের একটা সোর্স তো বেচারারা পেলো আজকে!

কিছুক্ষন পরে নিচে বিদ্ঘুটে শব্দে বেজে উঠলো অচেনা কোন একটা ইংরেজি গান, কিছুক্ষন কানপেতে শুনে বুঝলাম "কোপা শামসু" টাইপ ইংরেজি কোন গান হবে। S এবং X এই দুটি বর্ণের বহুল ব্যবহারে গানটির অবস্থা জির্নশীর্ণ। কৌতুহল হলো এ গানের সাথে অংগটি নাচছে, সেই হাত আর পা গুলো দেখার। বারান্দায় গিয়ে তাকালাম, গরম বাজনার সাথে কোন মতে তালহীন অবস্থায় নড়ে চড়ে যাচ্ছে এক কিশোর। রঙ্গিন বাতিটাতি জ্বেলে ব্যপারটার মধ্যে একটা মহিমা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে! অনেক কায়দা কানুনের পর বেচারার নাচ শেষ হলো, মানে গান শেষ হয়ে গেলো আরকি!

এইবার একটা কুইজ। "কইঞ্চেন দেহি, এর পর রাইত বারোটা পইযযন্ত ওই ডান্স অনুষ্টানে কি কি নেত্য পরিবেশন করা হইছেলো?" ঠিক ধরেছেন, এর পর বাকি ঘন্টাখানেক সময় বিকট সুরের হিন্দি, আর তার সাথে ততোধিক বিকট নৃত্য। অসম্ভব রিদমিক কিছু গান ছিলো, কিন্তু গান আর নাচের মহিমা যদি এক সুরে বাঁধা না হয় তাহলে দুইজনের সৌন্দর্যই বিনষ্ট হয় পুরোপুরি! আমার লেখার উদ্দেশ্য নাচের কোয়ালিটেটিভ কোন সঙ্গায়ন নয়। যেটা বক্তব্য সেটা হচ্ছে, আমাদের মন মজ্জা আর রক্তের সাথে মিশে যাওয়া অন্য এক সংস্কৃতির ভেতরটাকে দেখার একটু চেষ্টা। হিন্দি ছাড়া আমাদের কোন কিছুই সম্পুর্ণ হয় না এ এক আজব সত্য কথা! বিয়ের অনুষ্ঠান, বর্ষশেষের অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ, বর্ষ শুরুর অনুষ্ঠান!

খান সাহেব অলরেডি আমাদের বিষন্ন হওয়ার কিছু মাল মসলা দিয়ে গেছেন। আমরা আমাদের গাল, পিঠ, হৃদয়, পা... সবকিছু খান সাহেবদের দিয়ে দিয়েছি। অল্পের জন্য একজন হবু বউকেও দিয়ে দিচ্ছিলো! (যেভাবে খান সাব ম ম শব্দ দিয়ে কি সব করলেন, ভয় ই পাচ্ছিলাম!!)। আর ঘরে ঘরে ঘর ঘর কী কাহানী কাভি শাস ভি কাভি...... (বানান ভুল হলে ক্ষমা চাই) তো চলছেই। এইবার দেখলাম ঘরের নিচে, পাড়ায় রাস্তায় হিন্দির সুরে নাচন আর কুর্দন। কিছু হিন্দি গান আমার কাছে অসম্ভব সুন্দর মনে হয়। আমার মোবাইলে এক্টাই হিন্দি গান স্টোর করা আছে তু জানে না......এই অসম্ভব রিদমিক গান্টির বিরুদ্ধে আমি চাইলেও কিছু বলতে পারবোনা। কিন্তু নাচার জন্য মাঝি নাও ছাইড়া দের মতো ভালো গান আছে হিন্দিতে? আমাদের নাচার জন্য?

সংস্কৃতি হৃদয়ে লালন করার জিনিস, পালন করা প্রয়োজন একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। বর্ষশুরুর দিন রমনার বটমূল, ছায়ানটের রবীন্দ্র সঙ্গীত ছাড়া আমাদের সংস্কৃতির মূল সেতু আর কি আছে বলুন? এই ভীড় বাট্টায় যাওয়ার ইচ্ছাটা কেমন জানি মরে গেছে, কিন্তু টিভিতে ছায়ানটের অনুষ্ঠান না দেখলে ১লা বৈশাখের কোন গুরুত্ব কি থাকে? ভয়ে ভয়ে আছি কোন দিন জানি ক্যম্পাসে না জানি ১লা বৈশাখে বেজে উঠে ইশক ইশক...ধুম্মা চালে। স্বপন আর মাহফুজুর রহমান্দের বীজ তো বাংলাদেশেই আছে তাইনা?

শেষের ঘটনা হচ্ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্ধোধনি অনুষ্ঠানে অবদান রাখার জন্য আনা হচ্ছে বচ্চনদের, আসছে নৃত্যশিল্পিরা। সংখ্যাটা নাকি শয়ের কাছাকাছি। জানিনা লিস্টে নিপা, অর্ণব, হাবিব, তপুরা আছেন কিনা। মনে হয় নেই। খান সাহেবের আসার কোটা মনে হয় শেষ, তাই এখন বচ্চন আসবেন। বিশ্ববাসি দেখবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট হচ্ছ্ Indian subcontinent এ। বাংলাদেশকে ভাবতে পারে ভারতের একটি প্রদেশ। আমাদের জ্ঞানি গুনিরা বচ্চনদের পা ধোয়া পানি খেয়ে অমরত্ব লাভ করবেন, মাহফুজুর রহমান সাহেব হয়তো বউকে হিন্দির সাথে মিশিয়ে আরো মহিয়ান করে দেবেন। আর আমরা আমজনতা পাছায় আইক্কাঅলা বাঁশ অনুভব করেও হি হি করে হাসবো, হাততালি দিয়ে হাত ফাটিয়ে ফেল্বো!

ভরসা একটাই টাইগার নামক পুঁচকে ছোঁড়া গুলো ওইদিনই লোটাস কামালদের হতাশ করে দাদাদের হারিয়ে দেবে। সাকিবের চোখের আগুন আর হাতের ঘুর্ণিতে দিশা হারাবে ব্লুজ দের ব্যাট। তামিমের পিটুনিতে ত্রাহি অবস্থা হবে হরভজনদের। আমাদের সংস্কৃতির লোহিতকণিকায় হিন্দি সংস্কৃতির এই রিপ্লেস্মেন্টের চমতকার এক জবাব হবে সেটাই!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন